যশোরের পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা বা তদন্ত কমিটি হয়নি। এদিকে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ও সহকারী তত্বাধায়ক মাসুম বিল্লাহসহ কেন্দ্রের ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রব্বানি নিশ্চিত করেছেন। কেন্দ্রটি বর্তমানে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাফিজুল হকের উপস্থিতিতে নিহতদের ময়নাতদন্ত যশোর জেনারেল হাসপাতালে মর্গে সম্পন্ন হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়। এরা হলো- পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮), রাসেল ওরফে সুজন, (১৮) ও নাঈম হোসেন (১৭)।
এদিকে আহত ১৫ নিবাসিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে রূপককে শুক্রবার সকালে ও অন্যদের বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও তাদের অনুগামীদের নির্যাতনে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের এই তিন কিশোরের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে হাসপাতাল চিকিৎসাধীন কেন্দ্রের বন্দি নিবাসীরা।
আহত কিশোররা সাংবাদিকদের জানান, কেন্দ্রের প্রধান নিরাপত্তা কর্মীর সাথে দ্বন্দ্ব কারণে কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগী কয়েকজন কিশোরের মারপিটে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। তারা জানায়, কেন্দ্রের হেড গার্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মারপিটের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ও অন্য বন্দিরা বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত তাদের হাত পা মুখ বেঁধে দফায় দফায় মারধর করা হয়। পরে তাদের অচেতন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। সে কারণে বিনা চিকিৎসায় তাদের তিনজন মারা যায়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নিবাসী চুয়াডাঙ্গার পাভেল বলেছে, ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলেন। সেদিন কেন্দ্রের প্রায় ২০০ জনের চুল কেটে দেওয়ার কারণে আমার হাত ব্যথা ছিল। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেব জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে কয়েক কিশোর তাকে মারধর করে। বিষয়টি নূর ইসলাম অফিসে অভিযোগ করে বলেন, কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারধর করেছে। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে তারা মাদক সেবন করেনি।
পাভেল আরো জানায়, ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে আমাদের অফিসে ডাকা হয় এবং এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। আমরা ঘটনা জানানোর জানানোর এক পর্যায়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায় মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুফফিকসহ অন্যান্য স্যাররা মারপিটে অংশ নেন।
হাসপাতালে ভর্তি আহত আরেক কিশোর নোয়াখালির বন্দি জাবেদ হোসেন জানায়, স্যাররা ও অন্য বন্দি কিশোররা আমাদের লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে কুকুরের মতো মেরেছ। তারা জানালার গ্রিলের ভেতর আমাদের হাত ঢুকিয়ে তা বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে এবং পা বেঁধে মারধর করেন। অচেতন হয়ে গেলে আমাদের কাউকে রুমের ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে আসেন। জ্ঞান ফিরলে ফের একই কায়দায় মারপিট করেছে।
যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার বন্দি ঈষান জানায়, নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারপিট আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে। তাদেরকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয় বলেও ঈষান জানায়।
আহতরা আরও জানায়, মারধর করে তাদের এখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে একজন করে মারা গেলে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
নিহত কিশোর পারভেজের বাবা খুলনার মহেশ্বরপাশা এলাকার রোকা মিয়া শুক্রবার বলেন, আমার ছেলে প্রায়ই ফোনে বলতো এখানকার পরিবেশ ভালো না। কেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের নির্যাতন করা হয়। গতকাল সকালেও সে ফোন করে তাকে বড় জেলখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলে। পারভেজ আরো বলে- আমাকে যদি না নিয়ে যাও, তাহলে আমার লাশ নিয়ে যেতে হবে।
নিহত অপর কিশোর রাসেলের ভাই বগুড়ার শেরপুর এলাকার ফরহাদ আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে ভাই হারানোর বেদনা বোঝেন। তিনি নিশ্চয়ই এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করবেন।
এদিকে শিশু উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় বন্দি নিবাসীদের দুই পক্ষের সংঘর্ষকে দায়ী করেছে। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ বলেন, সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রডের আঘাতে ও মারপিটে মারত্ত্বক জখম হয় ১৪ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রেই তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আশঙ্কাজনক আহতদের একে একে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে নাঈম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
ঘটনার ব্যাপারে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বলা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি গঠনের পর তদন্তশেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, ঘটনাটি আমরা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে অবহিত করেছি। তিনি জানিয়েছেন- এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি থাকায় আগামী রবিবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে।
খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইডিজ একেএম নাহিদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। সে কারণে মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তারাই এই ঘটনার মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউই মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বিষয় গুরুত্ব পাবে।