ঢাকা: ‘করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পিরোজপুরের গ্রামের বাড়িতে তাকে শেষ দেখা দেখতে যেতে পারিনি। আত্মীয়-স্বজনরা আমাকে যেতে নিষেধ করে। শুধুমাত্র দুইবার ভিডিওকলে মৃত বাবাকে দেখেছি আমি। দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে।’
মঙ্গলবার
(২ জুন) এভাবেই বাংলানিউজকে নিজের কষ্টের কথা জানান করোনা জয় করে ফেরা
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মিনাক্ষী রানী
দাশ। দেশে নার্সদের মধ্যে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় মিনাক্ষীর শরীরে। তথ্য
গোপন করে চিকিৎসা নিতে যাওয়া এক করোনারোগীর সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হন
তিনি।
করোনা থেকে সেরে উঠলেও এখন পর্যন্ত সমাজ তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করছে না
জানিয়ে মীনাক্ষী বলেন, আমার মধ্যে করোনার লক্ষণ প্রকাশ পায় ১৯ মার্চ। ২৩
মার্চ নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ আসে। পরের দিন আমি কুয়েত-বাংলাদেশ
মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হই। এরপর দুইবার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ আসায় ৩১
মার্চ ছাড়পত্র পাই। তারপরও আরও দুইবার নমুনা পরীক্ষা করার পর নেগেটিভ
এসেছে। আক্রান্ত হওয়ার ৪২ দিন পর ৫ মে আমি পুনরায় অফিসের কাজেও যোগ দেই।
এরই মধ্যে ৯ মে পিরোজপুরে হার্টঅ্যাটাকে আমার বাবার মৃত্যু হয়।
‘মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে গ্রামে যেতে পারিনি। গ্রামের আত্মীয়-স্বজন আমাকে যেতে নিষেধ করে। তাদের নিষেধ অমান্য করে যেতেও পারিনি। কারণ, তারা আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। এ নিয়ে আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। শুধু দুইবার ভিডিওকলে মৃত বাবাকে দেখেছি। আমি সুস্থ, তবু বাবাকে সামনাসামনি দেখতে পেলাম না।’
এখনো মানুষের মধ্যে অনেক কুসংস্কার রয়ে গেছে উল্লেখ করে মীনাক্ষী আরও বলেন, আমরা রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। আমাদের ব্যাপারে বাসার মালিক খুবই আন্তরিক ছিল। কিন্তু সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর অন্যান্য ফ্ল্যাটর লোকজন বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলেছে। তারা আমাদের ভালোভাবে নেয়নি। আমার স্বামীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। গ্রামের বাড়িতেও অনেকেই যেতে নিষেধ করেছে।
এখন সারাদেশে করোনা ছড়িয়েছে। দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। করোনা আক্রান্তদের প্রতিবেশীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে মীনাক্ষী বলেন, আমরা প্রতিবেশী হয়ে আক্রান্তদের সহানুভূতি জানাতে না পারি, অন্তত যেন তাদের হেয় প্রতিপন্ন না করি। এতে আক্রান্তরা মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারেন। তা থেকে বড় দুর্ঘটনা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
করোনাকালীন অভিজ্ঞতা ও চিকিৎসা প্রসঙ্গে মীনাক্ষী বলেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি গরম পানি পান করেছি। নিয়ম করে হেঁটেছি, যাতে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি। আক্রান্ত হওয়ার পর বাসায় দুই শিশু সন্তানের কাছে যেতে পারিনি। ভিডিওকলে ওদের দেখেছি, যোগাযোগ করেছি। এখন আমি সুস্থ, তবে গলার স্বরটা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে কষ্ট হয়।
‘যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, তখন আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে বাবা সবসময়
খোঁজ রাখতেন, সাহস দিতেন। সহকর্মীরাও সবসময় খোঁজ রেখেছেন। মিডওয়াইফারি
অধিদপ্তর থেকেও অনেকে আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। এখনো তারা সাহস জোগান। যখন
হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, মাঝেমধ্যেই মৃত্যুভয় কাজ করতো। যখনই শ্বাসকষ্ট
অনুভব করতাম, তখনই মনে হতো এই বুঝি মৃত্যু হলো। কিন্তু মনের জোর ছিল
প্রচণ্ড। শ্বাসকষ্ট অনুভব করলেই নেবুলাইজার মেশিনের মাধ্যমে নিজে নিজেই
নেবুলাইজ করতাম। নার্সিং পেশাতে থাকার কারণে সবকিছু জানা ছিল, ফলে কাজগুলো
দ্রুত করতে পেরেছি। পরিবারের কথা চিন্তা করে, দুই বাচ্চার কথা চিন্তা করে
মনোবল চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করেছি।’
সেরে ওঠার পরের জীবন নিয়ে মীনাক্ষী বলেন, আমি সুস্থ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল,
কাজে যোগ দিই, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে, সহকর্মীদের সঙ্গে থাকতে পারলে
হয়তো একটু ভালো থাকতে পারবো। তাই কাজে যোগ দিয়েছি। ভালো আছি। সহকর্মীরা
খুবই সহায়তা করছেন। এখন ৭ দিন ডিউটি করি ৭ দিন ছুটিতে থাকি । মনোবল দৃঢ়
রেখে কাজ করে যাচ্ছি। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা কথা বলতে কষ্ট হয়। এটা কেটে
গেলে আমার আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। এখনো নিয়মমাফিক গরম পানি, আদা-চা পান
করি। নিয়ম করে হাঁটাহাটি করছি। যাতে আবারও কোনোভাবে অসুস্থ না হই।
করোনারোগীদের সেবায় নিয়োজিত নার্সদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা মানবতার
সেবায় নিয়োজিত আছি। সবসময়ই আমাদের সেবা করার মন-মানসিকতা আছে এবং থাকবে।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে পিছিয়ে থাকাটা আমাদের কখনোই কাম্য নয়। মনে
সাহস রেখে কাজ করে গেলে করোনা কিছুই করতে পারে না। এই করোনা ভাইরাসকে আমরা
জয় করবই।