আম্রপালি শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে হয়তো প্রথমেই সুস্বাদু মজাদার আমের কথা ভেসে আসে। ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা ‘দশোহরি’ ও ‘নিলাম’- এই দু’টি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন ‘আম্রপালি’। তবে আমরা আজ এই আম সম্পর্কে নয় এর নাম ও নামকরা অপরূপ সুন্দরী আম্রপালী সম্পর্কে জানবো।
বর্তমান বিহারে প্রাচীন ভারতে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বৈশালী নামে প্রসিদ্ধ নগর গড়ে উঠেছিল। পুরাতন পালি গ্রন্থ এবং বৌদ্ধ রীতিনীতিতে আম্রপালি এবং বৈশালী নগরের কিছু তথ্য পাওয়া যায়। আম্রপলি শব্দটি দুটি সংস্কৃত শব্দ আম্র যার অর্থ আম এবং পালি যার অর্থ কচি পাতা বা শাখা থেকে গৃহিত হয়েছে। বৈশালীর এক রাজকীয় আমগাছের নিচে তার জন্ম বিধায় তার নাম রাখা হয়েছিল আম্রপালি। বৈশালী ছিল লিচ্ছভি গোত্রের রাজধানী। বৈশালীতে তখন রাজা নির্বাচিত হতো ক্ষত্রীয় গোষ্ঠীর যুবরাজ ও অভিজাতদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচনী পরিষদ মন্ডলী দ্বারা। এক বিরল ধরনের প্রথা সেখানে প্রচলিত ছিল যা আজকের দিনে ভাবা যায় না। রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী নারী শুধু একজনকে বিয়ে না করে বরং সকলের সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে নিবেদন করবে।
আম্রপালি যেমন সুন্দরী ছিল তেমনি ছিল তার জ্ঞান বা প্রজ্ঞার সুনাম যা তাকে আরও খ্যাতি প্রদান করেছিল। অসাধারণ সৌন্দর্য ও লাবণ্যে অনন্যা এক নারী হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন এবং বিবিধ শিল্পজ্ঞানে প্রতিভাবান ছিল আম্রপালি। সমস্ত রাজ্যের তরুণরা তার সঙ্গ পেতে আকুল থাকতো। মনুদেব যখন বৈশালীর রাজা ছিলেন তখন সে আম্রপালির নৃত্য দেখে মুগ্ধ হয় এবং নিজে আম্রপালিকে অধিকার করে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। আম্রপালির বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার ছোটবেলার ভালোবাসা পুষ্পকুমারের সাথে। বিয়ের দিন পুষ্পকুমারকে হত্যা করে রাজা মনুদেব। এবং আম্রপালিকে নগরবধু হিসেবে ঘোষণা দেয়। তাকে সাত বছরের জন্য বৈশালী জনপদ কল্যায়ণী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আম্রপালি তার প্রেমিক নির্বাচন করতে পারতো তবে শর্ত ছিলো সে কখনো একজনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারতো না।
আম্রপালি এত সুনাম অর্জন করেছিল যে তখন বৈশালীর গৌরবের কৃতিত্ব তার প্রতিই নিবেদিত হতো। সে রাজদরবারের নৃত্যশিল্পীও হয়েছিলো। আম্রপালির শিল্প প্রতিভা দেখতে প্রতি রাতে পঞ্চাশটি কর্ষপান মুদ্রা ব্যয় করতে হতো। পরিস্থিতি এমন হয় কিছু কিছু রাজার কোষাগার থেকেও আম্রপলি অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে।
আম্রপালির খ্যাতি প্রতিবেশি মগধের রাজা বিম্বিসার পর্যন্ত পৌছে যায়। বৈশালী আক্রমন করে আম্রপালির বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিল। বিম্বিসার সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। কিছুদিনের মাঝেই আম্রপালি এবং বিম্বিসারের সাথে প্রণয় হয়। কিন্তু বিম্বিসারের আসল পরিচয় জানতে পেরে তাকে রাজ্য ত্যাগ করতে বলে। বিম্বিসার তাই করে।
বুদ্ধের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে বৈশালীতে ভ্রমন করেছিলেন। বৈশালীতে ধর্মোপদেশ দিয়ে বুদ্ধ ব্যপকভাবে আলোচিত হয়। আম্রপালি বুদ্ধকে নিজ গৃহে আমন্ত্রণ জানায় এবং বুদ্ধ নীরবে তার সম্মতি প্রকাশ করেন। আম্রপালির সৌন্দর্যে যেন শিশ্যরা মোহিত না হয় সেই কারনে বুদ্ধ নিজ শিশ্যদের সতর্ক করে দেয়। আম্রপালি বুদ্ধের আগমনে নিজ গৃহ সজ্জিত করে। পরবর্তীতে আম্রপালি নিজের সকল সম্পদ সমর্পন করে দেয় এবং বৌদ্ধ ধর্মের সক্রিয় সমর্থক হিসেবে কাজ শুরু করে। আম্রপলি দরিদ্র ও নিঃস্বদের সেবায় নিজের বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়।
প্রতিভাবান শিল্পী হিসেবে নিজের খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করার সত্ত্বেও বৈশালী যুবরাজগন আম্রপালিকে গণিকা উপাধি দিলেও বুদ্ধ একচোখা আচারণ করে নি। বুদ্ধ আম্রপালির গৃহে অন্নগ্রহণ করেছেন এবং ধর্মোপদেশের জন্য তার বাগানও গ্রহণ করেছেন।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক গন্থে আম্রপালি এবং বিম্বিসারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৪৫ সালে আম্রপালি নামে চলচিত্রও নির্মিত হয়ছিল।